The Daily Kalerchobi
May 3, 2024 Bangladesh

Blog Post

The Daily kaler chobi > অর্থ-বাণিজ্য > বাংলাদেশী জিম্মি জাহাজ মুক্তঃ মুক্তিপণের বিনিময়ে

বাংলাদেশী জিম্মি জাহাজ মুক্তঃ মুক্তিপণের বিনিময়ে

শেষ হলো ৩১ দিন রুদ্ধশ্বাস, জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশি নাবিকদের উচ্ছ্বাস ছবি : সংগৃহীত

♦ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ দুবাইয়ের পথে ♦ আট জলদস্যু গ্রেফতার সোমালি পুলিশের

কালের ছবি প্রতিবেদক‍‍ঃ

সোমালিয়ান উপকূলে রুদ্ধশ্বাস ৩১ দিনের বন্দিত্ব শেষে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিক। শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ৮ মিনিটে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর জাহাজটি নাবিকদের নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ২০ এপ্রিল নাগাদ হামরিয়া বন্দরে নোঙর করবে এমভি আবদুল্লাহ। ওই বন্দরে কয়লা খালাসের পর জাহাজের পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারণ করবে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশন। নাবিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী উড়োজাহাজ কিংবা এমভি আবদুল্লাহতে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে তাদের।কবির গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘জাহাজ জিম্মি হওয়ার প্রথম দিনই আমরা কাজ শুরু করি। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সহায়তা নিই। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বিষয়টা তদারকির নির্দেশ দেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে নাবিক ও জাহাজ মুক্ত করতে পেরেছি। আশা করি ১৯ কিংবা ২০ এপ্রিল জাহাজ হামরিয়া বন্দরে পৌঁছাবে।
সেখান থেকে উড়োজাহাজ কিংবা একই জাহাজে নাবিকদের চট্টগ্রাম ফিরিয়ে আনা হবে।’ গতকাল বিকালে জাহাজে থাকা এক নাবিকের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা এখনো মহাসাগরে সোমালিয়ান অংশে রয়েছি। এটা বিপজ্জনক জোন হিসেবে পরিচিত। এ জোন অতিক্রম করতে আরও তিন দিন লাগতে পারে। আমাদের জাহাজকে ইইউর নেভাল ফোর্সের দুটি জাহাজ স্কট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর সব নাবিক খোশমেজাজে রয়েছেন।’ জানা যায়, সোমালিয়ান জলদস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণ নিয়ে সমঝোতা হওয়ার পর মুক্তিপণের অর্থ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছোট উড়োজাহাজ ভাড়া করে অর্থ পরিবহনের জন্য নিয়োজিত সংস্থা।
ওই উড়োজাহাজ মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে এমভি আবদুল্লাহর ওপর চক্কর দিতে থাকে। এ সময় নাবিকদের জাহাজের ডেকে এক লাইনে দাঁড় করায় দস্যুরা। উড়োজাহাজ থেকে নাবিকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় হাত তোলার। এরপর সব নাবিক একসঙ্গে হাত তোলেন। সব নাবিক অক্ষত আছেন এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ডলারভর্তি তিনটি ব্যাগ এক এক করে ফেলা হয় সাগরে। জাহাজের পাশে আগে থেকেই স্পিডবোটে অপেক্ষায় ছিল দস্যুরা। জাহাজ থেকে ফেলার পর ডলারভর্তি ব্যাগ উল্লাস করতে করতে পানি থেকে সংগ্রহ করে দস্যুরা। ডলারভর্তি ব্যাগ সংগ্রহের পর তা আসল কি না পরীক্ষা করে দস্যুরা। আসল ডলার নিশ্চিত হওয়ার পর তা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেয়। শনিবার বিকালে মুক্তিপণের অর্থ পেলেও দস্যুরা তৎক্ষণাৎ জাহাজ থেকে নেমে যায়নি।
আরও আট ঘণ্টা পর ৬৫ জলদস্যু জাহাজ থেকে নামে। ধারণা করা হচ্ছে, জলে-স্থলে নজরদারি এড়াতেই গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের সময় জিম্মি জাহাজটির অদূরে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। আবার স্থলভাগে ছিল সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশের টহল। দস্যুরা নেমে যাওয়ার পর আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা দেয় জাহাজ।
৫০ লাখ ডলারে মুক্ত নাবিক ও জাহাজ : জলদস্যুদের কবল থেকে নাবিক ও জাহাজ মুক্ত করতে শনিবার বিকালে তিনটি ব্যাগে করে ডলার পৌঁছে দেওয়া হয় দস্যুদের কাছে। মুক্তিপণের বিষয়ে জাহাজ মালিক পক্ষ, বিমা কোম্পানি ও সোমালিয়ান দস্যু কেউ সরাসরি কথা বলেনি। তবে সোমালিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যম এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। সংবাদমাধ্যমগুলোয় দাবি করা হয়েছে, দস্যুরা ৫০ লাখ ডলার পেয়ে জাহাজ ছেড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি সোমালিয়া অনলাইনের এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় বলা হয়, ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জাহাজটি ছেড়ে দিয়েছে দস্যুরা। আরেকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পান্টল্যান্ড মিররের এক্স বার্তায় স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, ৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ নেওয়ার পর দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে দিয়েছে। পান্টল্যান্ড পোস্টের অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ আদায়ের পর দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে দিয়েছে। জলদস্যুরা তীরে পৌঁছার সময় সেখানে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিলেন।

তথ্য প্রকাশ না করতে চুক্তি : এমভি আবদুল্লাহর মুক্তিপণ নিয়ে মুখ না খুলতে চুক্তি হয়েছে জলদস্যুদের সঙ্গে। তাই কত টাকায় নাবিক ও জাহাজ মুক্ত করেছে সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ এসআর শিপিং করপোরেশন। সংস্থাটির সিইও মেহেরুল করিম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওদের কনফারেন্সিয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে মুক্তিপণের বিষয়ে আলোচনা না করার জন্য। সে অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আমি আপনাদের সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে পারব না। কারণ, এটা আমি সই করেছি। উদ্ধার প্রক্রিয়ায় আমরা আমেরিকান নিয়ম মেনেছি এবং ইউকে (যুক্তরাজ্য) ও সোমালিয়ার নিয়ম মেনেছি। ফাইনালি কেনিয়ার নিয়মও মেনেছি। সবার সঙ্গে আমাদের অ্যাগ্রিমেন্ট করা আছে এ বিষয়ে আলোচনা না করার জন্য।’

আট জলদস্যু গ্রেফতার : মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে সোমালিয়ান উপকূলে পৌঁছানোর পর অন্তত আট দস্যুকে গ্রেফতার করেছে সোমালিয়া পুলিশ। সোমালিয়ার স্থানীয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘গারোই’ এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করে রাখা আট দস্যুকে গ্রেফতার করেছে পান্টল্যান্ড পুলিশ। তবে দস্যুদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা উদ্ধার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করেনি ওই গণমাধ্যম।

ইবাদতে দিন কেটেছে নাবিকদের : জলদস্যুদের হাতে বন্দি হওয়ার দিন থেকে মুক্ত হওয়া পর্যন্ত ইবাদতে দিন কেটেছে নাবিকদের। গতকাল বিকালে কথা হয় দুই নাবিকের সঙ্গে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বন্দিজীবনগুলো রমজানে হওয়ায় আমাদের কষ্ট খুবই কম হয়েছে। আমরা রোজা রাখছি শুনে দস্যুরা ভালো আচরণ করেছে। আমরা একসঙ্গে ইফতার ও সাহরি খেয়েছি। খাবার ও পানির কোনো সংকট ছিল না। ঈদের নামাজও আদায় করেছি একসঙ্গে। প্রসঙ্গত, ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজে ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক।

ডলারের ব্যাগের ছবি কোন সিনেমার জানি না : প্রতিমন্ত্রী : এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করতে মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই। জলদস্যুদের ব্যাগে করে মুক্তিপণ দেওয়ার যে ভিডিও সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রতিমন্ত্রী। সেই সঙ্গে ঈদের দিন ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএর সার্ভেয়ারদের দুর্বলতা থাকলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেছেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল ঈদের পর প্রথম কর্মদিবসে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, নাবিকদের মুক্ত করতে জলদস্যুদের ডলারের ব্যাগ দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা কোন সিনেমার ছবি আমি তো জানি না। এমন ছবি তো আমরা অনেক চলচ্চিত্রে দেখি। কোন ছবি কোথায় গিয়ে কীভাবে যুক্ত হয়েছে, কোনটার সঙ্গে কোনটা এডিট হয়েছে আমি জানি না।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, জলদস্যুদের কাছে খবর ছিল জাহাজে কোনো আর্মড গার্ড নেই। সে সুযোগেই তারা জাহাজটি আটক করে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই জাহাজে আর্মড গার্ড ছিল। যদি এখনো আর্মড গার্ড থাকত তাহলে হয়তো জলদস্যুরা এমন দুঃসাহস দেখাত না বলেও উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী। উড়োজাহাজ থেকে ব্যাগ ফেলার ভিডিওর বিষয়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, জানতাম পরিত্যক্ত জিনিস পানিতে ফেলে। এত দামি জিনিস (ডলার) পানিতে ফেলে জানা ছিল না। বহুমাত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নাবিকদের উদ্ধার করা হয়েছে। চাপের কারণেই দস্যুরা বাধ্য হয়েছে ছাড়তে। আর কিছুদিন গেলে কী পরিণতি হতো, তারা তা বুঝতে পেরেছে বলেই ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

খালিদ মাহমুদ বলেন, আমরা আইএমওর (আন্তর্জাতিক সমুদ্র চলাচল সংস্থা) সি ক্যাটাগরির সদস্য। আমরা একটা প্রস্তাব তৈরি করছি, যেটা নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। আইএমওতে যে ১৭৪টি দেশ আছে, তাদের কাছে আমরা একটা প্রস্তাব দেব কীভাবে আমাদের সমুদ্রপথটা নিরাপদ রাখতে পারি। ঈদের দিন সদরঘাটের দুর্ঘটনা নিয়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আমরা এ জায়গাটায় খুবই শক্ত আছি। যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। এখানে যদি আমাদের সার্ভেয়ারদের কোনো দুর্বলতা থাকে সেটাও শাস্তির আওতায় আনা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঈদের দিন আমরা উৎসবমুখর মুডে ছিলাম।? সেখানে এ ধরনের একটি ঘটনা ঈদের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে। জাহাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেকে কিন্তু পালিয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *